জি নিউজ অনলাইনঃ- একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। গতকাল বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ১ এই আদেশ দেন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, নিজামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর প্রমাণিত হওয়ায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগের জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। বাকি ৫, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় নিজামীকে খালাস দেয়া হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার নিজামীর রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছরের ২৪ জুন নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হলেও অসুস্থতার জন্য নিজামীকে আদালতে হাজির করতে না পারায় ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা তৃতীয় দফায় অপেক্ষমাণ রাখেন।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের ১৬ অভিযোগে বিচার হয়েছে নিজামীর। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ১৫টিই প্রমাণিত হয়েছে দাবি করে আদালতের কাছে সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের দাবি নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ গণহত্যা, সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অভিযোগসহ ১৯৭১ সালের কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তিনি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবেন বলে আশা করেন তারা। এদিকে, রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত নয়টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে তিনটি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ছয়টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। নিজামী বাদে এখন দুই ট্রাইব্যুনালে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণা বাকি থাকল। এছাড়া আপিল বিভাগে জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায়টি অপেক্ষমাণ রয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় যুক্তিতর্ক শেষে গত ২৪ মার্চ নিজামীর মামলার রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল-১। এর আগে এই ট্রাইব্যুনালের সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর গত বছরের ১৩ নভেম্বর নিজামীর মামলার কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন। বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের চাকরির বয়সসীমা পূর্ণ হওয়ায় তিনি গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর অবসর নেন। সেই থেকে চেয়ারম্যানের পদটি শূন্য ছিল।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমকে। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ২৪ জুন রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন। কিন্তু ধার্য দিনে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেনি। পরে স্বাস্থ্যগত প্রতিবেদন চেয়ে নিজামীর মামলার রায় ঘোষণা আবারো অপেক্ষমাণ রাখেন ট্রাইব্যুনাল। নিজামী সুস্থ এই মর্মে প্রতিবেদন আসার প্রায় চার মাস পর আজ রায় ঘোষণা করা হয়।
২০১২ সালের ২৮ মে নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল-১-এ তার বিচার শুরু হয়। ঐ বছরের ২৬ আগস্ট থেকে এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানসহ এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন। আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের যত অভিযোগ: মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার ১৬টি অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। যদিও রাষ্ট্রপক্ষ ১৫টি অভিযোগে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতী নদীর পাড়ে আরো কয়েকজনের সঙ্গে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১০ মে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় ছিলেন নিজামী। সভার পরিকল্পনা অনুসারে ১৪ মে দুইটি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪৫০ জনকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। এছাড়া প্রায় ৩০-৪০ জন নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। নিজামী ঐ ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
চতুর্থ অভিযোগ হলো পাবনার করমজা গ্রামে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটের ঘটনায় নিজামীর সম্পৃক্ততা।পঞ্চম অভিযোগ হলো, একাত্তরের ১৬ এপ্রিল নিজামীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী উপজেলার আড়পাড়া ও ভূতের বাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে বাড়িঘর লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় ২১ জন নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়।
ষষ্ঠ অভিযোগ হলো একাত্তরের ২৭ নভেম্বর ধুলাউড়া গ্রামে ৩০ জনকে হত্যায় নিজামীর নেতৃত্ব ও সম্পৃক্ততা।
সপ্তম অভিযোগ হলো একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর সোহরাব আলী নামক এক ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হত্যা।
অষ্টম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
নবম অভিযোগ হলো একই বছরের ৩ ডিসেম্বর হিন্দু অধ্যুষিত বিশালিখা গ্রামে ৭০ জনকে গণহত্যা।
দশম অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুন্ডুর বাড়িতে আগুন দেয়।
১১ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এ ছাড়া, ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য ১২ নম্বর, ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় বক্তব্যের জন্য ১৩ নম্বর এবং ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্যের জন্য ১৪ নম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
১৫ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের মে মাস থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী ও রাজাকার সামাদ মিয়ার ষড়যন্ত্রে সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।১৬ নম্বর অভিযোগ বুদ্ধিজীবী নিধনের। জামায়াতের তত্কালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্ম নেয়া নিজামী ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসেবে একাত্তরে তিনি ছিলেন আলবদর বাহিনীরও প্রধান। খবর:রেডিও তেহরান, স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।