দ্রুত একটি নতুন নির্বাচনের জন্য চাপ দিতে ওবামা প্রশাসনকে আহ্বান

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ- আমেরিকার সিনেটে বাংলাদেশ নিয়ে শুনানি, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু একটি প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে দ্রুত একটি নতুন নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ-গত ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন হয়েছে তা ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ এবং বিতর্কিত। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করেছে, যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তাই যুক্তরাষ্ট্র চায় বিরোধী দলের সাথে সংলাপের মাধ্যমে অতিদ্রুত একটি অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। গতকালমঙ্গলবার মার্কিন সিনেটে বাংলাদেশবিষয়ক এক শুনানিতে এ কথা বলা হয়। পাঁচটি মুখ্য ইস্যুতে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ইস্যুগুলো হলোÑ সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জিএসপি, বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটিতে এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয় সিনেটর রবার্ট মেনেনদেজের সভাপতিত্বে।দুই পর্বের এই শুনানির প্রথম পর্বে প্যানেল সদস্যরা বলেন, বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তা ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ এবং বিতর্কিত। এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতাপূর্ণ সংলাপ আয়োজনের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বর্তমান সরকারকে আরো চাপ দেয়ার জন্য ওবামা প্রশাসনকে আহ্বান জানায় সিনেট কমিটি। জিএসপি প্রসঙ্গে প্যানেল সদস্যরা বলেন, এই সুবিধা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করেছে, তবে তাদের আরো শর্ত পূরণ করতে হবে। শ্রমিকদের অবস্থার এখনো উন্নয়ন হয়নি এবং অবস্থা উন্নতিকল্পে যে সব শর্ত দেয়া হয়েছে তার অনেকটাই এখনো পূরণ হয়নি। তারা বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শাস্তি দেয়ার জন্য সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ড. ইউনূসের সাথে সরকার যা করেছে তা অন্যায়। এটা বাংলাদেশ ও আমেরিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। শুনানিতে দক্ষিণ মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আমি মনে করি বাংলাদেশ এখন একটি সঙ্কটজনক অবস্থানে রয়েছে। তাই সময় উপযোগী এই শুনানির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়া যাবে যে- বাংলাদেশ যে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। শুনানির প্রথম পর্বে প্যানেলিস্ট হিসেবে নিশা দেশাই বিসওয়াল ছাড়াও ছিল মার্কিন অন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক এসোসিয়েট ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি এরিখ আল বিয়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবিষয়ক বাণিজ্য সহকারী লুইস, সিনেটর ডারবিন।৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে সিনেট কমিটিতে আগেও শুনানি হয়েছিল। কমিটির চেয়ারম্যান মেনেনদেজ রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশের নেতাদের চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যা তিনি শুনানির প্রারম্ভিক বক্তব্যে তুলে ধরেন।শুনানিতে নিশা বিসওয়াল বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে তার সরকারের মূল্যায়ন সিনেট কমিটিতে তুলে ধরেন, যা সিনেটের ওয়েবসাইটেও প্রকাশিত হয়েছে।বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও অনুষ্ঠিত গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানে অটল আওয়ামী লীগকে সংলাপের তাগিদ দিতে সেই নির্বাচনের আগে ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন নিশা বিসওয়াল।শুনানিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন। গত ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ত্রুটিপূর্ণ একটি নির্বাচন করেছে, যাতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি অংশ নেয়নি। ৩০০ আসনের সংসদে অর্ধেকেরও বেশি আসনের প্রার্থীদের বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়াকে এই নির্বাচনের দুর্বলতা হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। সিনেট কমিটিতে তিনি জানান, ‘এই নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষের আকাক্সার প্রতিফলন ঘটেনি। এর ফলে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা দেখা দিতে পারে, যার প্রভাব ওই অঞ্চলেও পড়বে।’ভোটের আগে নভেম্বরে তার ঢাকা সফরের সময় দুই প্রধান নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে সংলাপের তাগিদ দেয়ার বিষয়টিও শুনানিতে তুলে ধরেন নিশা বিসওয়াল।বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং তার সাথে ব্যবসায়ী নেতারা গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে ‘সঠিক’ পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সেই সাথে নিশা দেশাইও বলেছেন বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে এবং তার হারানোরও অনেক কিছু আছে,’ -সতর্কবার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী মন্ত্রী।স্বাধীনভাবে নির্বিঘেœ রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ করে দিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।  সেই সাথে বিরোধী দলকেও শান্তিপূর্ণ পন্থায় কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান নিশা বিসওয়াল। তিনি উল্লাস করেন যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ যে প্রদক্ষেপ নিয়েছিল তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। সিনেট কমিটিকে তিনি জানান, নির্বাচনের পর আমরা কড়া বিবৃতি দিয়ে বলেছিলাম এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। এবং সাথে নতুন নির্বাচন নিয়ে সংলাপ করার জন্যও আহ্বান জানিয়ে ছিলাম আমরা। নিশা দেশাই আরো বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের হাতে যে রিপোর্ট আছে তাও উদ্বেগজনক। অবিলম্বে এই সব বন্ধ করতে হবে। আমরা যেকোনো সহিংসতার নিন্দা জানাই। গণতন্ত্রে এটা কোনো কৌশল হতে পারে না।বাংলাদেশ থেকে এসে শুনানিতে অংশ নেয়া বাংলাদেশ সেন্টার পর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আকতার বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টরের সার্বিক অবস্থার চিত্র উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের প্রায় সবাই অবগত রয়েছেন ট্রেড ইউনিয়ন প্রদত্ত অধিকার সম্পর্কে। কিন্তু মালিকপক্ষের রক্তচক্ষুর কাছে তাদের সে চেতনা জাগ্রত হতে পারে না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এ ধরনের পরিবেশ দূর করতে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক সহায়তা প্রত্যাশা করেন তিনি। ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সংগঠনটির চেয়ারম্যান এলেন টাউসার বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের নানা সমস্যা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বড় ধরনের দু’টি দুর্ঘটনা ঘটার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন তথা শ্রমিকের নিরাপত্তায় সত্যিকার অর্থে কোনো পদক্ষেপ গৃহিত হয়েছে বলে মনে করতে পারি না।
প্র্রায় সোয়া দুই ঘণ্টার এ শুনানিতে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপপ্রধান এম এ মুহিত ও বাণিজ্যিক কাউন্সেলর শফিকুল ইসলাম, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা ড. শাহজাহান মাহমুদ, মাহমুদুন্নবী বাকি, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির নেতা জাহিদ এফ সরদার সাদী, শরাফত হোসেন বাবু, গোলাম ফারুক শাহীন, পারভেজ সাজ্জাদ, রাশেদ খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শুনানি শেষে কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর ম্যানেন্ডেজ জানান, বাংলাদেশ পরিস্থিতির আলোকে আজকের শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সাথে কথা বলব। আমরা আশা করছি বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশার পরিপূরক পরিবেশ শিগগির তৈরি করতে রাজনীতিক-সুশীল ও শ্রমিক সমাজ একযোগে কাজ করবেন। সূত্র-ওয়েবসাইট তাঃ-১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪

 

Exit mobile version