আগৈলঝাড়ার বধ্যভূমি কেতনার বিলে ৪২ বছরেও নির্মিত হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ

অপূর্ব লাল সরকার, আগৈলঝাড়া (বরিশাল) থেকে :স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও বরিশালের আগৈলঝাড়ার কেতনার বিলে শত শত শহীদের গণকবরের খবর কেউ রাখেনি। আজ পর্যন্ত ন্যূণতম স্মৃতিচিহ্নও সংরক্ষণ করা হয়নি। উপেক্ষিত রয়ে গেছে বরিশালের আগৈলঝাড়ার সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি কেতনার বিল। যুদ্ধচলাকালীন হিন্দু অধ্যষিত ‘বাকাই’ গ্রামসহ টরকী বন্দরে পাকসেনারা হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। ওইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয় ৭ জন পাকসেনা। এ খবর পাকসেনা ক্যাম্পে গেলে তারা পরদিন ওই এলাকায় অভিযানে চালানোর প্রস্তুতি নেয়। এদিকে এলাকার লোকজন প্রাণ বাঁচাতে সকাল থেকেই তাদের শেষ সম্বল নিয়ে বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলার বিলাঞ্চল বাকাল, কোদালধোয়া গ্রামে যাবার জন্য কেতনার বিল দিয়ে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে। ইংরেজিতে বাকাই এর স্থলে আই’র উপর বিন্দু না পড়ায় তারা বাকাইকে ‘বাকাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে। গৌরনদী থেকে ওই গ্রামে রাস্তা দিয়ে যেতে হলে রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের উপর দিয়ে যেতে হয়। ওইদিন ১৯৭১ সন মোতাবেক বাংলা ১৩৭৮ সাল এর ১ জ্যৈষ্ঠ রোববার ছিল। পাকসেনারা ‘বাকাল’ গ্রামে যাবার পথে সকাল দশটা বা সাড়ে দশটার সময় পাকসেনারা রাংতা এসে কেতনার বিলের দিকে তাকিয়ে শত শত মানুষ ছুটতে দেখে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে ছিল। প্রাণের আশায় বাঁচতে দৌঁড়ে ছুটে চলা পাখির মত গুলি খেয়ে তাৎক্ষণিক ওই মাঠেই শহীদ হয় শত শত শিশু ও নারী পুরুষ। পাকসেনাদের ব্রাশফায়ারে আশপাশের গাছের পাতা ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ওই সময় যারা পাশের গ্রামে লুকিয়ে ছিল তারা সন্ধ্যার দিকে এসে কেতনার বিলে শুধু লাশের স্তুপই দেখতে পায়। স্বজন হারানোর বেদনায় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন আত্মীয় স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী। কেতনার বিলের মধ্যের একমাত্র ‘পাত্র বংশীয়’  কাশীনাথ পাত্র, বিনোদ পাত্র, বিনোদের স্ত্রী সোনেকা পাত্র, মেয়ে গীতা পাত্র, কানন পাত্র, মঙ্গল পাত্র, মঙ্গলের মা হরিদাসী পাত্র, মেয়ে অঞ্জলি পাত্র, দেবু পাত্রর স্ত্রী গীতা পাত্র, মোহন পাত্র, মেয়ে ক্ষেত্র পাত্র, কার্তিক পাত্রর স্ত্রী শ্যামলী পাত্র, ১২ দিনের শিশু অমৃত পাত্র, মেয়ে মঞ্জু পাত্র, মতি পাত্র,  লক্ষীকান্ত পাত্রের স্ত্রী সুমালা পাত্র, নিবারণ বিশ্বাসসহ একই বাড়ির ১৯জন প্রাণ হারায় ওইদিন। এরমধ্যে ১২ দিনের শিশু অমৃতকে পাকসেনারা বুটজুতা দিয়ে পিষে এবং নিবারণকে রাইফেলের বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। টরকী-গৌরনদীসহ আশেপাশের এলাকার শত শত লোকের লাশ পরে থাকে কেতনার বিলের মধ্যে। তখন প্রাণ বাচাঁতে পালানো মানুষের ভিড়ে লাশ সৎকার বা কবর দেয়ার কোন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পরেছিল। তারপরেও ‘মৃত্যুকূপ’ নামে খ্যাত ওই পাত্রবাড়ির বেঁচে যাওয়া হরলাল পাত্র ও অমূল্য পাত্রর নেতৃত্বে হরলালের ছেলে সুশীল পাত্র, কেষ্ট পাত্র, রাধাকান্ত পাত্রসহ কয়েকজন পরদিন তাদের হারানো স্বজনসহ দেড়শতাধিক লোকের লাশ এনে মাত্র ৫-৬টি গর্ত করে পাত্রবাড়িতে মাটি চাপা দেয় হয়। বাকি লাশগুলো আর সৎকার করতে না পারায় সেগুলো কেতনার বিলের শিয়াল-কুকুরের খাবার হয়ে পরে থাকে। এব্যাপারে আব্দুর রইচ সেরনিয়াবাতসহ কয়েকজন আগৈলঝাড়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কয়েকজন নেতা দেড়বছর আগে বধ্যভূমি ঘুরে গেলেও আজও কিছুই হয়নি। মৃত্যুকূপ পাত্রবাড়ির জীবিত বর্তমান বংশধররা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার সরকারের কাছে আগৈলঝাড়ার সর্ববৃহৎ বধ্যভূমি কেতনার বিল সংরক্ষণ ও শত শত শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য একটি স্মৃতিস্তভ নির্মাণের দাবি জানান।

 

Exit mobile version